সিক্রেটটা হল পরিমিত পরিমাণে শাক সবজি খাওয়া, খাদ্য তালিকায় মাত্র এই একটি উপাদানের উপস্থিতিই আপনাকে বাঁচিয়ে দিতে পারে অপুষ্টি, রক্তশূণ্যতা, দৃষ্টিহীনতা, দুর্বলতা, জ্বর-ঠাণ্ডা, হৃদরোগ, ওজনের মত সমস্যাগুলো থেকে। শাক ও সবজিতে আপনি পাবেন ভিটামিন, শর্করা, আমিষ, খনিজ লবণ, স্নেহ, মিনারেলের মত আসংখ্য জরুরি উপাদান যার অনুপস্থিতিতে আপনার দৈহিক ও মানসিক বিকাশ হতে পারে বাধাগ্রস্থ। তবে আজকাল বাজারে যেসব শাক-সবজি মিলছে তা যে আপনার শরীরের জন্য সত্যি উপকারি সে নিশ্চয়তা দেওয়ার উপায় নেই, বরং যারা মাছ মাংসে ভেজালের ভয়ে শুধু সবজি খেয়ে জীবন ধারনের কথা ভেবেছিলেন তাদের দ্বিতীয়বার এই বিষয়টি বিবেচনা করে দেখা উচিৎ।
কৃষকের জমি থেকে পাইকার তারপর খুচরা ব্যবসায়ী হয়ে সবজি যখন আমাদের হাতে আসে তখন তাতে পুষ্টি উপাদান কতটা থাকবে তার নিশ্চয়তা না থাকলেও ক্ষতিকর উপাদান যে ভরপুর মাত্রায় থাকবে তার শতভাগ নিশ্চয়তা আছে। সবজির দূষণটা শুরু হয় কৃষকের ক্ষেত থেকেই, একেতো রয়েছে নানা জাতের হাইব্রিড ফসলের বীজ তার সাথে যুক্ত হয় রাসয়ানিক সার ও কীটনাশকের অতি ব্যবহার । এর সাথে আছে এগুলো সহ বিভিন্ন ক্যেমিকেল এর অপব্যবহার। ফসলের ক্ষয়ক্ষতি কমাতে ও পোকামাকড়ের হাত থেকে বাঁচতে কৃষক জমিতে কীটনাশকের প্রয়োগ করবেন এতে ভুল কিছু নেই, কিন্তু জিনিসটা হুমকির পর্যায়ে পড়ে তখনি যখন তা নির্দিষ্ট মাত্রা ছাড়িয়ে যায় এবং কীটনাশক ব্যবহারের প্রায় সাথে সাথেই যখন তা বাজারে বিক্রির উদ্দেশ্যে পাঠানো হয়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের থেকে জানা যায় কীটনাশকের প্যাকেটে থাকে সবুজ, নীল, হলুদ ও লাল দাগ। বাকিগুলো কীটপতঙ্গকে একটু ধীরে মারলেও লাল প্যাকেটের কীটনাশক প্রয়োগে পোকামাকড় মারা যায় সাথে সাথেই। কৃষি বিশেষজ্ঞরা স্বল্প মাত্রার কীটনাশক ব্যবহার করার পরামর্শ দিচ্ছেন এবং কীটনাশক ক্ষতিকর প্রভাব কমাতে ব্যাবহারের অন্তত ৭ দিন পর বাজারজাত করার কথা বললেও সে নির্দেশে কেউ কর্ণপাত করছে না। মাঠের ৪০% সবজিতেই পাওয়া যাচ্ছে মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশকের উপস্থিতি, যেখানে পাইকারি বাজারের ৩২% সবজিতে এবং খুচরা বাজারের ২৮% সবজিতে রয়েছে কীটনাশক। বাজারের শতকরা ৯১ ভাগ মরিচেই রয়েছে কীটনাশক যা সহনশীল মাত্রার থেকে ৫ গুণ বেশি, লাল শাকে ৩১ গুণ, এবং ফুলকপিতে ১০ গুণ বেশি মাত্রায় কীটনাশক বিদ্যমান। বেগুনে প্রতি কেজিতে ১২৮.২৮ মিলিগ্রাম কুইনাফস নামক কীটনাশকের অস্তিত্ব রয়েছে যেখানে ১০ মি.গ্রা হচ্ছে সহনীয় সীমা, অন্যদিকে শিমেও ২০ গুণ পরিমান বেশি পাওয়া যায় ডাইমেথয়েড নামক কীটনাশক। আলু, টমেটো, শসা, পটল, গাজর, বাধাকপি, করল্লা, চিচিঙ্গা, ঢ্যাঁড়স, ধনিয়াপাতা সব ধরনের সবজিতেই থাকে ম্যালাথিন, ক্লোরোপাইরিফস, প্যারাথিয়ন, মেটালাক্সিলও নামক কীটনাশক। শুধু কীটনাশক দিয়েই ব্যবসায়ীরা ক্ষান্ত হচ্ছে না, বাজারের সবজির পচন ঠেকাতে ও তাকে তরতাজা দেখাতে এতে মেশাচ্ছে ফরমালিন , ক্ষতিকর রঙ ও কেমিক্যাল। টমেটোর মত কাঁচা সবজিগুলো দ্রুত পাকাতে ব্যবহার হচ্ছে ইথিফন নামক রাসায়নিক, ঝকঝকে করতে শ্যাম্পুজলে ধোয়াসহ পচনরোধ ব্যবহৃত হচ্ছে ডায়াথেন জাতীয় মেডিসিনও।
দূষিত এইসব সবজি খাওয়ার পরিণামটা ভায়াবহ। পাকস্থলীর বিভিন্ন রোগসহ কিডনী ও লিভারকে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্থ করে কেমিক্যালগুলো। ধীরে ধীরে স্নায়ুকে দুর্বল করে মানুষের কার্যক্ষমতাকে কমিয়ে দেয়, রোগতন্ত্র, রোগনিয়ন্ত্রন ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (IEDCR/আইইডিসিআর) জানায়, এইসব পেটে গেলে হতে পারে ডায়রিয়া, পেটে ব্যথা, হাঁপানি, দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যাওয়া, চুলকানি, বমিসহ হৃদযন্ত্র, ফুসফুস ও লিভার ডিজিস। এতে সবথেকে বেশি ক্ষতি হচ্ছে শিশুদের, একই প্রতিষ্ঠানের গবেষণা বলছে এতে রয়েছে শিশু মৃত্যুর সম্ভবনাও। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) eর তথ্য মতে সারা পৃথিবীতে প্রতি বছর ৩০ লাখ মানুষ কীটনাশকের বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয় এবং ২০ হাজার মানুষ মৃত্যুমুখে পতিত হয়, যার মধ্যে উন্নয়নশীল দেশের মানুষের সংখ্যাই বেশি। গর্ভবতীদের এই বিষগুলো আক্রান্ত করে অনেক বেশি মাত্রায়, এর ফলে জন্ম নিতে পারে শারীরিক ও মানসিক ভাবে পরিপক্ব শিশু, এমনকি প্রতিবন্ধী শিশুরও জন্ম হতে পারে । মা বিষজাতীয় খাবারগুলো খেলে বুকের দুধের মাধ্যমে তা শিশুর শরীরেও প্রবেশ করে, শিশুকে ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে রক্ষা করতে চাইলে তাই প্রসবকালীন সময়ের পরেও এইসব খাবার থেকে মাকে দূরত্ব বজায় রাখতে হবে।
জাপানে সবজি চাষে ব্যবহৃত হয় আমাদের দেশের থেকেও বেশি কীটনাশক, কিন্তু পরিকল্পিত ব্যবস্থা, পরিমিত পরিমাণে ব্যবহার ও নিয়ম মেনে বাজারজাত করায় তা মানবদেহে কোন ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে না। এদেশের কৃষকদেরও অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহার হ্রাস করতে হবে এবং কীটনাশক ব্যবহার ও বিক্রির সময়ের মধ্যে কমপক্ষে ৭ দিনের নিশ্চিত করতে হবে। অর্গানিক উপায়েও পোকামাকড় নিধন ও সবজি চাষ শুরু করা যেতে পারে। অর্গানিক সবজিগুলো অতো বেশি আকর্ষণীয় হয় না, চকচক করলেই যে সোনা হয় না তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ বলা যেতে পারে বাজারের সুন্দরতম সবজিগুলোকেই, তাই কেনার সময় আমাদের চকচকে সবজির প্রতি আকৃষ্ট হলে চলবে না। আসুন সচেতন হয়, ভেজালের বিরুদ্ধে কথা বলি, অনিরাপদ পণ্য বর্জন করি এবং নিজেরা নিরাপদ থাকি ও অন্যদের নিরাপদই রাখি।
কৃতজ্ঞতায়ঃ এনটিভি, দৈনিক ইত্তেফাক, সি নিউজ, দি ডেইলি স্টার, দেশবিদেশ.কম, মাছরাঙ্গা টিভি, নিউজ২৪, যমুনা টিভি।

সবজির বিপদ ও ভয়াবহ পরিণাম
Website | + posts
Cart
  • No products in the cart.