গরম গরম ভাতের সাথে ঝাল ঝাল শুটকি ভর্তার কল্পনা যেকোন বাঙ্গালির মুখে জল এনে দেবার জন্য যথেষ্ট। স্বাদে তো বটেই পুষ্টিগুণেও শুটকি কম যায় না, আমিষ, প্রোটিন, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, লৌহ, ক্যলরি, খনিজ লবণ ও ভিটামিনের প্রকৃষ্ট উৎস এই শুটকি। নদীমাতৃক এবং সমুদ্র কূলবর্তী দেশ হিসেবে আমাদের দেশে মেলে রূপসা, চাঁদা, চ্যালা, কোড়াল, রিঠা, চাপলী, সামুদ্রিক পুঁটি, চিংড়ি, ইলিশ, কাঁকচি, লক্কা, সোনাপাতা, শাপলাপাতা, বাইনের মত সুস্বাদু সব মাছের শুটকি। দেশে মাছের ৫ শতাংশ চাহিদা মেটায় শুঁটকি, আবার রপ্তানির মাধ্যমে ২০১২ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর ২০০ কোটি টাকা আয় করার রেকর্ডও রয়েছের শুটকির। নদী ও সমুদ্র থেকে মাছ সংগ্রহের পর তা রোদে শুকিয়ে, প্যাকেটজাত করে তারপর দেশ ও বিদেশের বাজারে সরবরাহ করা হয়ে থাকে যার বড় অংশই উৎপাদিত হয় কক্সবাজারে।
পূর্বের দিনে দাদি-নানিরা নিজ হাতে শুটকি তৈরি করে তা তুলে দিত পরিবারের পাতে, কিন্তু সেইসব দিন গত হবার দরুন এখন আমাদের একমাত্র ভরসা বাজারের শুঁটকি। দেশে- বিদেশের বিপুল চাহিদার এই শুঁটকির মাননিয়ন্ত্রন করা জরুরি হলেও এর বর্তমানে এর রক্ষণাবেক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাত ব্যবস্থা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে সবার মনে। শুঁটকিকে দীর্ঘস্থায়ী করতে এতে নির্বিচারে চলছে কেমিক্যাল ও রাসায়নিক পদার্থের ব্যবহার। বিভিন্ন টিভি চ্যানেল এবং জাতীয় দৈনিকের মাধ্যমে জানা যায় শুটকিতে ডাইক্লোরো ডাইফিনাইল ট্রাই ক্লোরাইথেন (ডিডিটি) নামক একটি পাউডার জাতীয় ঔষুধের ব্যবহারের কথা। এই ঔষধটি ব্যবহারের ফলে মাছে সহজে পচন ধরে না, পোকামাকড় বা ব্যাকটেরিয়া অক্রমণ করে না এবং শুঁটকি দীর্ঘদিন ভাল থাকে। এর কম মূল্য এবং সহজলভ্যতা শুঁটকি ব্যবসায়ীদের কাছে একে অধিক জনপ্রিয় করে তুলেছে। এছাড়া নানান ধরনের তরল ধরনের রাসায়নিকও শুটকিতে স্প্রে করা হয়ে থাকে। জেলেদের মতে এই ঔষুধ মাছে দিলে তাতে ব্যাকটেরিয়া হয় না, শুঁটকি হয় চকচকে ও দীর্ঘস্থায়ী। ইন্ডিপেনডেন্ট টিভির অনুসন্ধানে উঠে এসেছে সবিক্রন ৪২৫ নামে আর একটি মেডিসিনের নাম। এইসব রাসায়নিক পদার্থ বা ঔষুধ আসলে একপ্রকার কীটনাশক, যা ফসল বা গাছের পোকামাকড় দমন করতে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। মানুষের পেটে এমন মেডিসিন প্রবেশ করলে হতে পারে বদহজম, পেটের পীড়া, খোসপচড়া, চর্মরোগ, লিভার ক্যান্সার, কিডনি ড্যামেজের মত রোগ। পরিমানে অল্প হওয়ায় এইসব কেমিক্যালের প্রভাব আমারা তৎক্ষণাৎ উপলব্ধি করতে পারি না, কিন্তু ধীরে ধীরে কেমিক্যালগুলো আমাদের বডিসেলে জমা হতে থাকে এবং দেহের কোষকে ধ্বংস করে ক্যন্সারের মত রোগ সৃষ্টি কারণ হয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ জনাব খান আবুল কালাম আজাদ বলেন, এই মারাত্মক বিষ আমাদের স্নায়ু তন্ত্রে গিয়ে তাকে দুর্বল করে দেয় এবং তিলেতিলে আমাদের মৃত্যুর দিকে নিয়ে যায়। স্নায়ু বৈকল্য, জণ্ডিস, গডব্লাডার ক্যান্সার, পিত্ত থলির পাথর, ডায়রিয়া ইত্যাদি রোগের প্রাদুর্ভাবের জন্য এইসব কেমিকেলযুক্ত খাবারই দায়ী।
আবহাওয়ার সংস্পর্শে অতি দ্রুত নষ্ট হয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে শুঁটকির, আর আমাদের দেশের জেলেদের সঠিক পদ্ধতিতে শুঁটকি তৈরি ও সংরক্ষণের জ্ঞান না থাকায় এটি অল্প সময়েই খাবার অনুপযোগী হয়ে পড়ে। তাই সম্ভাব্য লোকসান এড়াতে ব্যপারীরা বেছে নিয়েছে এই ক্ষতিকর ফরমানিল, বাসুডিন, নগজ, ডায়াজিনের মত বিষাক্ত ঔষধগুলো। এই ঔষুধের প্রভাবে মাছে কোন গন্ধ থাকে না, এমনকি পচা মাছ শুঁটকি করলেও গন্ধ শুকে বোঝা যাবে না কিছুই। এই কেমিক্যাল এতই ভয়াবহ যে মাছে ঔষুধ দেওয়ার পর এর আসেপাশে কোন জীবিত কীটপতঙ্গও ঘোরাফেরা করে না। গর্ভবতী নারির জন্য এই শুঁটকি বিপদজনক প্রমাণ হতে পারে। এর ফলে গর্ভের শিশু প্রতিবন্ধী, দুর্বল, মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন হতে পারে এমনকি গর্ভপাতের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। অধিক দিন এইসব ঔষধ শরীরে প্রবেশ করলে নারী ও পুরুষের প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস পেতে পারে, অসময়ে বন্ধ্যত্ব বরনের নজিরও আছে কিছু জায়গায়।
চট্টগ্রাম এ ক্যান্সার রেট হাই হওয়ার জন্য ওখানকার মানুষের বিষাক্ত শুঁটকির খাদ্যাভ্যাসকে দায়ী করা হচ্ছে।
শুঁটকি শুধু মানুষের খাদ্য হিসেবেই নয় মাছ ও মুরগীর খামারেও এর ব্যবহার ব্যপক। কিন্তু ভেজাল এইসব শুটিকি মাছ মুরগীর খামারে ব্যবহার করলে শুটকিতে ব্যবহৃত কেমিক্যাল ঢুকে যেতে পারে মাছ ও মুরগীর শরীরে। এতে করে না শুধু শুঁটকি অন্যান্য মাছ ও মাংসও হয়ে যাচ্ছে খাবার অনুপযুক্ত এবং এসব অস্বাস্থ্যকর খাবার খেয়ে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে অসংখ্য জটিল রোগে। হুমকিজনক এই পরিস্থিতি থেকে রেহায় পেতে সচেতনতা আবশ্যক। তৈরি করতে হবে মৎস্য সংরক্ষণাগার ও হিমাগার, জেলে ও ব্যাপারিদের সঠিক পদ্ধতিতে মাছ সংরক্ষণ শেখাতে হবে এবং জানাতে হবে কেমিক্যাল ব্যবহারের ক্ষতিকর দিকগুলো। সনাতন পদ্ধতি এড়িয়ে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে শুঁটকি তৈরির দিকে আমাদের মনযোগী হতে হবে। শুঁটকির গায়ে সাদা সাদা বিন্দু দেখলে বা এর কোন ঘ্রাণ না পেতে তা কেনা থেকে বিরত থাকতে হবে আর সব জায়গাতে গড়ে তুলতে হবে ভেজাল বিরোধী আন্দোলন।
সূত্রঃ দৈনিক জনকণ্ঠ, খাসফুড, ডেইলি ইনকিলাব, প্রিয়।কম, প্রথম আলো, উকিপিডিয়া, তালাশ, দৈনিক নবরাজ, বাংলা নিউজ২৪, somewherein.blog.net ।
এরকম তথ্যবহুল প্রতিবেদন লিখে আমাদেরকে সচেতন করার জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।