আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ, কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে এই ভবিষ্যৎ গোড়াতেই যেন ধ্বংস হতে বসেছে। ভেজালে ভরা খাদ্য বাজারে আমারা সবাই ভুগছি নিরাপত্তাহীনতায়, তবে সবথেকে যারা বিপদের মধ্যে রয়েছে শিশুরা। মানবতা বিবর্জিত কিছু মানুষ শিশু খাদ্যকেও ভেজাল থেকে নিস্তার দিচ্ছে না যার ফলে আজকাল বাবা-মাকে শিশু জন্মের আগে থেকেই তার নিরাপদ ভাবে বেড়ে ওঠা নিয়ে থাকতে হয় দুশ্চিন্তায়।
শিশু খাদ্যের প্রধান উৎস হিসেবে ধরা হয় দুধকে। দুধে রয়েছে ফ্যাট, ল্যাকটোজ, প্রোটিন, এসএনএফ সহ নানা পুষ্টি উপাদান। গোয়ালের থেকে খাঁটি দুধ পাওয়ার তেমন আশা না থাকায় শহরবাসী মানুষকে তাদের বাচ্চাদের এই দুধের চাহিদা মেটাতে নির্ভর করতে হয় প্যাকেটজাত তরল বা গুঁড়া দুধের উপর। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর আগে থেকেই এইসব কৌটার দুধ শিশুকে দিতে সম্মত না থাকলেও প্রয়োজনের তাগিদে অনেককেই বেছে নিতে হচ্ছে এই শিশু খাদ্যগুলো। কিন্তু, সম্প্রতি ল্যাকটালিস নামক দুগ্ধজাত পণ্যের জনপ্রিয় ফরাসি কোম্পানির গুড়ো দুধ, যেমন বেবি কেয়ার ১,২,৩ এবং বেবি কেয়ার এমএফ তুলে নেওয়া হচ্ছে বাজার থেকে। অভিযোগ হিসেবে বলা হচ্ছে সারমোনেলা নামক ব্যাক্টেরিয়ার উপস্থিতির কথা। ল্যাকটালিস কোম্পানির মত নামীদামী কোম্পানির দুধে ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি শিশুর খবারে ভেজালের পরিমাণটা আঁচ করতে আমাদের সাহায্য করছে। নিয়মিত পরীক্ষা অভাব, কর্তৃপক্ষের অযোগ্যতা, সার্বিক সচেতনাতার আকালের সুযোগ নিয়ে কিছু ব্যবসায়ী মেয়াদ উত্তীর্ণ, ব্যাক্টেরিয়া ও ফাঙ্গাস আক্রান্ত এইসব শিশু পণ্য তুলে দিচ্ছে ভোক্তাদের হাতে। দুধ, সুজি, ভুট্টা, চালের গুড়ো ও ফলের সঠিক মাত্রায় ৬ থেকে ২ বছরের শিশুদের জন্য তৈরি আকর্ষণীয় প্রোডাক্ট পাওয়া যায় বাজারে যা সরল মনে শিশুদের মুখে তুলে দেওয়া থেকে বিরত থাকুন। জানা যায় বাজারের শতকরা ৯০ ভাগ দুধ ও ৬০-৬৫ ভাগ শিশু খাদ্যেই রয়েছে ভেজাল। চীনে গুড়ো দুধে মেলামাইন পাওয়ার খবর আমাদের সবার জানা, এই ভয়াবহতা বজায় রাখতে আমাদের দেশে গুড়ো দুধের সাথে মেশানো হচ্ছে সোডিয়াম, সাবান, কস্টিক সোডা, রঙ ও বরিক পাউডার।
গরুকে মোটাতাজা ও রোগমুক্ত রাখতে বিভিন্ন ঔষুধ ও এন্টিবায়োটিকের ব্যবহার তো ছিলই এখন আবার গরুর দুধ বাড়াতে পিটুইটারি নামক ইনজেকশনও দেয়া হচ্ছে গরুর শরীরে। দেশে মোট দুধের চাহিদা বছরে ১ কোটি ৩৩ লাখ টন হলেও উৎপাদিত হচ্ছে মাত্র ২৯ লাখ ৫০ হাজার টন, ঘাটতি পরা এই দুধের চাহিদার সুযোগ নিয়ে তৈরি হচ্ছে ভেজাল দুধ। ছানার পানির সাথে কিছুটা গরুর দুধ, কাপড় কাঁচা সোডা, চিনি, তেল ও লবণ, ব্যাস তৈরি হয়ে গেল খাঁটি আসল দুধ। সাথে আছে নষ্ট আটা, ময়দা, ভাতের মাড়, হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড, স্যালিসাইলিক, ইউরিয়া, ফেবার, সোডিয়াম বেনজোয়েট, আলকাতরার ব্যবহারও। এই ভেজাল দুধ চলে যায় বড় বড় দুগ্ধজাত খাদ্য তৈরিকৃত কোম্পানিগুলোতে, ব্র্যান্ডের নামের নিচে ঢাকা পড়ে যায় দুধের সব দোষ। আবার নামি কোম্পানির নাম, সিল ও প্যাকেট ব্যবহার করে কিছু আসাধু ব্যবসায়ী চালিয়ে যাচ্ছে নকল দুধের ব্যবসায়ও। দুধের পচনশীলতা ঠেকাতে এতে ফরমালিন নামক বিষ ব্যবহারের প্রমাণও মিলেছে, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার ফলাফল হচ্ছে বরিশাল অঞ্চলে ১০ শতাংশ দুধে ফরমালিন ও ২০ শতাংশে সোডিয়াম বাই কার্বোনেট মিশ্রিত থাকে,এ থেকে সারা দেশের দুধের অবস্থা আঁচ করতে অসুবিধা হবার কথা না। শিশুদের খাদ্য তালিকার আর একটি নাম সুজি, ভেজালকৃত গম থেকে তৈরি এই সুজিও এখন আর নেই খাবার উপযোগী। দীর্ঘদিন অরক্ষিত ভাবে রাখার ফলে এমন করেই অনেক শিশু খাদ্যে জন্ম নিচ্ছে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক ও পোকামাকড়। এছাড়া শিশুদের পছন্দের আইসক্রিম, চিপস, চকলেট, বিস্কুটসহ অন্যান্য খাবারগুলোতেও চলে কেমিক্যাল ও ক্ষতিকর রঙের ব্যবহার।
স্বভাবতই শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বড়দের তুলনায় অনেক কম, তাই শিশুদের উপর দূষিত এইসব খাদ্যের প্রভাবও পড়ছে মারাত্মক ভাবে। ঢাকা মেডিকেল কলেজের তথ্যমতে জুলাই ২০১২ থেকে ফেব্রুয়ারি ২০১৬ সালের মধ্যে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে শিশু ভর্তির সংখ্যা ৫৫৭ জন প্রকৃত রোগী আরও অনেক বেশী। শিশুদের জিনগত পরিবর্তন করে ক্যান্সার সৃষ্টি করছে দূষিত খাবার । ভেজাল খাবার ফলে শিশুদের পেটের পিড়া, পেটে ঘা, আলসার, চর্মরোগ এমনকি মৃত্যু হতে পারে। দূষিত খাবারে বাচ্চাদের দেহকোষ, মস্তিষ্ক, কিডনি ও লিভার সরাসরি অক্রান্ত হচ্ছে, তাদের ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে দেখা দিচ্ছে হাঁপানি রোগ, তাদের রক্ত চলাচলেও ব্যাঘাত সৃষ্টি হচ্ছে বলে বাংলাদেশ রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের কারিগরি উপদেষ্টা ডাঃ মশতাক হোসেন জানান। ২০০৭ সালে ল্যানসেটের গবেষণায় শিশুদের আচরণগত সমস্যার জন্যও ভেজাল খাবারকে দায়ী করা হয়েছে। যারা গর্ভাবস্থায় আছেন তারা গর্ভপাত, বিকলাঙ্গ শিশু জন্মদান, প্রসবকালীন জটিলতা এড়াতে চাইলে এই ভেজাল দুধ ও দুধের তৈরি খাবার থেকে দূরেই থাকুন।
কৃতজ্ঞতাঃ প্রথম আলো, ইন্ডিপেন্ডেট টিভি, আর টিভি, দৈনিক যুগান্তর, বাংলাদেশ প্রতিদিন, ঢাকা টাইমস, দৈনিক ইত্তেফাক, যমুনা টিভি।