মধুর ইতিহাস
মধু হচ্ছে এক প্রকার ঘন ও তরল জাতীয় আঠালো মিষ্টি পদার্থ। সাধারণত মধু সংগ্রহকারী পতঙ্গ মৌমাছিরা ফুলের নির্যাস থেকে মধু সংগ্রহের কাজটি করে থাকে। এখানে মধু সংগ্রহ করার জন্য মৌমাছিদের বিভিন্ন শ্রেণীতে ভাগ হয়ে কাজটি সম্পন্ন করে থাকে। একটি মৌচাকে থাকে একটি রানী মৌমাছি , কিছু সংখ্যক পুরুষ মৌমাছি এবং অধিক সংখ্যক শ্রমিক মৌমাছি থাকে।
রানী মৌমাছি ও পুরুষ মৌমাছিদের কাজ হচ্ছে বংশ বিস্তার করা । আর মধু সংগ্রহের এই মূল কাজটি করে থাকে শ্রমিক মৌমাছির দল । তারা ফুলের নির্যাস গ্রহণ করে এবং তাদের হানি স্টমাক বা মধু পাকস্থলীতে জমা রাখে । দিনের শেষে মৌচাকে ফিরে এসে শ্রমিক মৌমাছির দল সংগ্রহিত মধু হানি সেল গুলোতে জমা করে। পরবর্তীতে মৌয়ালরা সে সকল মৌচাক কেটে সংগ্রহ করে থাকেন সুপ্রেয় মিষ্টি মধু।
মধু ব্যবহারের প্রাচীন ইতিহাস
পৃথিবী সৃষ্টির আদিকাল থেকে মধু ব্যবহার করে আসছে মানুষ নানা রকম ভাবে । খ্রীষ্টপূর্ব প্রায় ৭০০০ বছর আগে থেকে মানুষ মধু ব্যবহারের সাথে পরিচিত হয়েছিল। কেনিয়ায় বসবাস-রত মাসাই উপজাতি গণ মধু কে ঈশ্বর কর্তৃক প্রেরিত মিষ্টি পানীয় মনে করতেন এবং দল বেধে তারা বাউবেব নামক গাছ থেকে মধু সংগ্রহ করতেন। মায়া সভ্যতায় বিয়ের কনে কে মধু উপহার দেয়ার রীতি ছিল ।
গ্রিক সভ্যতায় মধু
গ্রিকরা মনে করত মধু শুধু একটি গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য নয় , শক্তিশালী একটি ঔষধ ও বটে । তাছাড়া গ্রিকদের খাদ্য সংস্কৃতিতে প্রায় বিশাল একটা অংশ জুড়ে ছিল মধু। তারা মিষ্টি জাতীয় সকল খাবারে মধুর ব্যবহার করত। গ্রিকদের রান্নার রেসিপি বই গুলোতে মধুর তৈরি মিষ্টি খাবার গুলোর পদ বেশি পাওয়া যায়। গ্রিকদের শাসন আমলে মৌমাছির প্রতিচ্ছবি তৈরি মুদ্রার প্রচলন ছিল ।
রোমান সভ্যতায় মধু
রোমানরা মনে করত ঈশ্বরের আশীর্বাদ হচ্ছে মধু । তারাও রান্নায় অধিক পরিমানে মধু ব্যবহার করতেন। ১৭০০ শতকের দিকে ইউরোপের লোকেরা চিনির বদলে মধু ব্যবহারের পরিমান বাড়িয়ে দিয়ে ছিল।
মিসরীয় সভ্যতায় মধু
মিশরীয় শাসন ব্যবস্থায় মধুকে এন্টিসেপ্টিক হিসেবে ব্যবহার করা হতো বিশেষ করে যুদ্ধের সময় তারা বিভিন্ন সরজ্ঞামের সাথে মধুর জার নিয়ে যেতেন । যাতে সৈনিকরা আহত হলে ক্ষত স্থানে মধু লাগিয়ে তাড়াতাড়ি সাড়িয়ে তোলা যায় । রানী ক্লিওপেট্রা রূপচর্চায় মধুর ব্যবহার ইতিহাস বিখ্যাত হয়ে আছে এখনও । ২৪০০ খ্রিষ্টপূর্ব দিকে মিশরের সূর্য মন্দিরের দেয়ালে মৌমাছির ও মধুর পাএের ছবি তৈরি প্রতিকৃতির সন্ধান পাওয়া যায় যা ছিল কায়রো শহরের খুব কাছে।
ইসলাম ধর্মে মধুর কথা
পবিত্র হাদিস শরিফে মধু সম্পর্কে প্রচুর রেওয়ায়েত রয়েছে । বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)- এর মতে সকল পানীয় উপাদানের মধ্যে মধু হচ্ছে সর্বোৎকৃষ্ঠ পানীয়। তিনি বলেন- মধু এবং কোরআনের মাধ্যমে তোমাদের চিকিৎসা নেয়া উচিত। -(সুনানে ইবনে মাজাহ, হাকেম) ইবনে মাজাহ ৩৪৫২।
রাসূলুল্লাহ (সা.) স্বয়ং নিজে সকাল বেলা খালি পেটে মধুর শরবত পান করতেন । যারা নিয়মিত ভাবে মধুর শরবত পান করতে না পারবে তাদের জন্য তিনি বলেন- যে ব্যক্তি মাসে তিন দিন সকাল বেলা মধু চেটে সেবন করবে, ওই মাসে তার কোন কঠিন রোগব্যাধি হবে না। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন- যে কেউ আরোগ্য কামনা করে, তার ভোরের নাশতা হিসাবে পানি মিশ্রিত মধু পান করা উচিত ।
মধুর পুষ্টিগুণ
মধুর রং, স্বাদ ও গন্ধ মৌমাছির সংগৃহীত মধু ধরনের উপর নির্ভরশীল । মধু হাজার বছরেও নষ্ট হয় না। কারণ মধুতে রয়েছে মাএ ১৪ শতাংশ পানি যার কারণে মধু দীর্ঘ দিন পুষ্টিগুণ সহ ভালো থাকে।
মধুতে প্রায় ৪৫টি খাদ্য উপাদান রয়েছে ।
ফুলের পরাগের মধুতে থাকে
- ২৫ থেকে ৩৭ শতাংশ গ্লুকোজ,
- ৩৪ থেকে ৪৩ শতাংশ ফ্রুক্টোজ,
- ০.৫ থেকে ৩.০ শতাংশ সুক্রোজ এবং
- ৫-১২ শতাংশ মন্টোজ আছে।
- আরো রয়েছে ৮০ শতাংশ কারবোহাইড্রেট ,
- ২২ শতাংশ অ্যামাইনো এসিড,
- ২৮ শতাংশ খনিজ লবণ ,
- ১৮ শতাংশ পানি এবং
- ১১ ভাগ এনকাইম
মধুতে কোন প্রকার ফ্যাট , কোলেস্ট্ররল ও সোডিয়াম নেই । ১ টেবিল চামচ মধু থেকে ৬৪ ক্যালরি ও ১৭ গ্রাম চিনি পাওয়া যায় । মধুর মধ্যে রয়েছে ভিটামিন বি১, বি২, বি৩, বি৫, বি৬, আয়োডিন, জিংক ও কপার সহ এন্টিব্যাকটেরিয়াল ও এন্টিমাইক্রোবিয়াল, এন্টিফ্যালামেটরি উপাদান যা আমাদের দেহের সুরক্ষায় কাজ করে।
মধুর ব্যবহার
মধুর ব্যবহার মানুষ সৃষ্টির শুরু থেকে করছে যা এখনও কোন অংশে কমেনি । বিজ্ঞানের আধুনিক গবেষণার সুফলে মধুর নিত্য নতুন ব্যবহার আমরা দেখতে পাচ্ছি। তবে উল্লেখ যোগ্য কিছু ব্যবহার রয়েছে মধুর।
স্বাস্থ্য উপকারিতায়
স্বাস্থ্যের থেকে মধুকে খাবার এবং ঔষধ দুটোই ধরা হয়। মধু সকল বয়সের মানুষের জন্য বেশ উপকারী। চিনির বিপরীতে মধুর ব্যবহার শত ভাগ নিরাপদ।
১. মধু এন্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ
অপ্রকিয়াজাতকরণ এবং ভাল মানের মধুতে এন্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে প্রচুর পরিমানে। এতে থাকা প্রাকৃতিক এসিড ফ্লাবিনয়স উপাদানটি মধুতে এন্টিঅক্সিডেন্ট তৈরি করে। যা রক্তে মিশে বাড়তি কোলেস্টেরলের মাএা কম করে এবং হার্ট এ্যাটাকের ঝুঁকি, স্ট্রোক কমায় এবং ক্যান্সরের সেল শরীরে উৎপন্ন হতে বাধা দেয়।
২. মধু উচ্চ রক্ত চাপ ঝুঁকি কমায়
উচ্চ রক্ত চাপ বেশ ঝুঁকি পূর্ণ হার্টের রোগের ক্ষেত্রে। নিয়মিত মধু খেলে অনেকাংশে এই সকল ঝুঁকি এড়ানো সম্ভব। কারণ মধুতে থাকা এন্টিঅক্সিডেন্ট শরীরের উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে আপনার হার্টকে রাখে সুরক্ষিত।
৩. মধু শরীরের কোলেস্টেরলের মাএা কমায়
বর্তমান সময়ে বেশ মারাত্নক একটি সমস্যা রক্তে কোলেস্টেরলের মাএা বেড়ে যাওয়া। যা হার্ট এ্যাট্রাকের অন্যতম প্রধান কারণ। মধু রক্তে থাকা খারাপ কোলেস্টেরল LDL এর মাএা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে এবং রক্তে ভাল কোলেস্টেরলের মাএা HDL বাড়িয়ে দেয়। সবচেয়ে বড় কথা হলো মধু সেবনে কোলেস্কোলেস্টেরল বাড়ার কোন ঝুঁকি নেই। তাই কোলেস্টেরল নিয়ে যারা দুশ্চিন্তায় রয়েছেন , তারা অনেকটা নিশ্চিন্তভাবে চিনির বিপরীতে মধুকে ব্যবহার করতে পারেন।
৪. ট্রাইগ্লিসেরাইডের ঝুঁকি হ্রাস করে মধু
ট্রাইগ্লিসেরাইড হচ্ছে আমাদের শরীরের তিনটি ফ্যাটি এসিড গ্রুপের একটি। যার অতিরিক্ত মাএার উপস্থিতি আমাদের হার্ট এ্যাটাকের ঝুঁকি সহ আরও বিভিন্ন রকম হার্টের রোগ দ্বিগুণ বৃদ্ধি করে। তাছাড়া ডায়াবেটিস টাইপ – ২ এর রোগ বৃদ্ধি করে ট্রাইগ্লিসেরাইড।
এক গবেষণায় দেখা গেছে, চিনি ট্রাইগ্লিসেরাইডের লেভেল শরীরে বৃদ্ধি করে। অন্যদিকে মধু ট্রাইগ্লিসেরাইডের লেভেল শরীরে বেড়ে উঠতে বাধা দেয়। তাই চিনির বদলে মধুর স্বাদ স্বাস্থ্যের পক্ষেও ভালো।
৫. হার্ট সুস্থ রাখে মধু
বর্তমান সময়ে বড় একটি চ্যালেন্জ হার্টকে সুস্থ রাখা৷ কারন হার্ট সুস্থতো আপনি ফিট।
মধু হচ্ছে ফিনোলস্ এবং এন্টিঅক্সিডেন্ট কমপ্লেক্স সমৃদ্ধ সবচেয়ে ভাল উৎস। মূলত এই দু’টি উপাদান আমাদের হার্টে রক্ত প্রবাহ সচল রাখে। এতে হার্ট সুস্থ থাকে। সে প্রাচীনকাল থেকে এখনও পযর্ন্ত মধু সেবনকে হার্টের সুস্থতার কার্যকরী পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
৬. মধু কফ উপশমকারি
ঠান্ডা জনিত যেকোন রোগে মধু অনেকটা মহা ঔষধের মতো কাজ করে। বিশেষ করে কাশি ও কফ উপশমে মধুর কোন তুলনা নেই। আমেরিকার এক গবেষণায় দেখা গেছে মধু কফ উপশমকারি যেকোনো ওষুধের চেয়ে দ্বিগুণ কার্যকর। আরেক গবেষণায় দেখা গেছে কফ উপশম করার ছাড়াও ঘুম ভাল হওয়ার প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করে।
৭. ওজন কমাতে সাহায্য করে মধু
চিনি থাকা হাই ক্যালরি ওজন বৃদ্ধির জন্য অনেকটা দায়ী। চিনির বিপরীতে মধুর ব্যবহার আপনাকে ওজন বৃদ্ধির এই কবল থেকে অনেকটা রক্ষা করবে। আজকাল ডায়েট চার্টে ডাক্তারগণ মধু রাখার পরামর্শ দেন।
মধুর তৈরি যেকোন পানীয় আপনার মেটাবলিজম সিস্টেমকে ভালো রাখে এবং হাই ক্যালরি প্রদানের মাধ্যমে আপনার পেটকে দীর্ঘক্ষন ভরিয়ে রাখে।