ভারতীয় উপমহাদেশে রান্নায় মসলা ব্যবহারের রসনাবিলাস সেই মুঘল জামানা থেকেই। ভিন্ন ভিন্ন মসলার রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন স্বাদ ও গন্ধ, যার ফলে একেক মসলা খাবারে আনে একেক রকমের স্বাদের বৈচিত্র। স্বাদ বর্ধন প্রধান উপযোগিতা হলেও মসলার পুষ্টিগুণও কিছু কম নয়। গ্যাস্টিকের অসুবিধা, হজমে সমস্যা, কিডনী রোগ, হৃদপিণ্ডের রোগসহ অনেক কঠিন রোগের মহাঔষুধ এই মসলা। আবার ছোটখাটো অসুখবিসুখে ও কাটাছেড়ায় ঘরোয়া সমাধান দেয় মসলার কৌটা। আগের দিনে পাটায় পিষে বা ঢেঁকিতে ভেঙ্গে আস্ত মসলাকে গুড়ো করে রান্নায় প্রয়োগের উপযোগী করা হত আর এখন হাতের কাছে প্যাকেট করা অবস্থায় পাওয়া যায় যেকোন মসলা কোনোরকম কষ্ট ছাড়াই।
অসাধু ব্যবসায়ীদের খপ্পরে পড়ে এখন এই মসলার অবস্থাও হয়েছে বেহাল। কেমিক্যাল ও রঙের প্রভাবে মসলা যেন হারিয়ে ফেলছে তার স্বাদ ও সৌরভ আর হয়ে উঠছে স্বাস্থ্যের জন্য বিপদজনক।
আমাদের রান্নাঘরের খুব পরিচিত একটি মসলা হচ্ছে মরিচ গুঁড়ো, প্রায় সব খাবারেই ব্যবহৃত এই মসলাটিতে আসাধু কিছু লোক মিশিয়ে চলেছে কাউন ও ইটের গুড়া। রাজধানীসহ সব জেলাতেই চলছে এই ভেজাল মসলার উৎপাদন ও বিকিকিনি। বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের গবেষণায়ও উঠে এসেছে ভেজাল মসলা সম্পর্কিত ভয়াবহ সব তথ্য। কাউন যা কিনা পাখি খাদ্য হিসেবে পরিচিত একপ্রকার ঘাসের বীজ তা গুড়ো করে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে মসলা নামে। এছাড়াও মসলার সাইনবোর্ডে আমাদের খাওয়ানো হচ্ছে কাঠের ভুসি, ইটের গুড়া, চালের ক্ষুদ, সুজিসহ আরো বেশকিছু অখাদ্য। ভেজাল মসলার হুমকিটা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে এতে কেমিক্যাল ও রঙের প্রয়োগ। কাপড়ে দেওয়া লাল রঙ্গের সাথে কাউন বা ইটের গুঁড়া মিশিয়ে বানিয়ে ফেলা হচ্ছে মরিচের গুড়া, ঝালভাব আনতে তাতে যুক্ত করা হচ্ছে পচা ও নিম্নমানের মরিচ। হলুদ রঙ ব্যবহার করা হচ্ছে হলুদ গুড়ো তৈরিতে আর চোখে ধুলো দেবার জন্য এতেও দেওয়া হচ্ছে কিছুটা আসল হলুদ গুড়া। এই কারণেই এখন রান্নায় যতই মরিচ বা হলুদের গুঁড়া দেওয়া হোক না কেন, খাবারে না আসে ঝাল স্বাদ না পাওয়া যায় কাঙ্খিত রঙ। কনজিউমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ ও সচেতন ভোক্তা সমাজের তৈরিকৃত এক প্রতিবেদন থেকে আরো জানা যায় জিরা আর ধনিয়ার গুঁড়ার সাথে কাঠের গুড়া, পোস্ত গুঁড়ার সাথে সুজি ব্যবহারের কথা। সাথে আছে সিঁদুর, পচা গম, পচা ভুট্টা, ঘাসের বীজ, ভুট্টা গাছের গুড়া, গম ও ধানের তুষ ইত্যাদির মত অখাদ্য সব উপাদানের ব্যবহারের খবরও। ওজন বাড়ানোর প্রবণতায় ভেজাল ব্যবসায়ীরা আবিষ্কার করে চলেছে নিত্য নতুন সব পন্থা আবার অপরদিকে কাঁচামালের মূল্য বৃদ্ধির অজুহাতে মসলার দামটাও বাড়িয়ে চলেছে জ্যামিতিক হারে। ভেজাল মসলার এই সয়লাব থেকে বাদ পড়েনি গরম মসলাও। দারুচিনি, লবঙ্গ, তেজপাতা, জয়ফল, এলাচ থেকে আগেই বের করে নেয়া হচ্ছে বিদ্যমান এসেনশিয়াল ওয়েল আর তা আলাদাভাবে বিক্রি করা হচ্ছে অধিক মূল্যে। মসলার নামে আমাদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে যেসব অবশিষ্ঠ খোসা আর বাকল তাতে থাকছে না কোন সুগন্ধ বা স্বাদ।
ভেজাল এই মসলার স্বাদের কথা না হয় বাদই দিলাম কিন্তু এর ক্ষতির দিকটা এড়ানো সম্ভব না কোনমতেই। খাবার অযোগ্য উপাদানগুলো দ্বারা তৈরি এইসব মসলা খেলে হতে পারে মারাত্মক পেটের সমস্যা; এমনকি গ্যাস্ট্রিক, আলসারে মত কঠিন রোগও বাসা বাধতে পারে আপনার শরীরে। অতিরিক্ত মাত্রায় এই মসলা পেটে গেলে আপনি শিকার হতে পারেন ফুড পয়জনিং এর। টেক্সটাইলে ব্যবহৃত রঙ খাবার উপযোগী নয় কোনভাবেই, কিন্তু এর হচ্ছে হরহামেশা ব্যবহার। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্যাস্ট্রোএন্টিরোলজি বিভাগের সহকারি অধ্যাপক ডাঃ মোঃ জাহিদুল রহমানের কাছ থেকে জানা যায় প্রথম দিকে এইসব কেমিক্যাল রঙ পেটে গেলে গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা হয় এবং পরে তা ধারন করে ক্যানসারের রূপ। এইসব খাবার ফলে হেপাটাইসিস সহ কিডনিজনিত আরো জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে মানুষের মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। এছাড়াও স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে মসলাগুলো তৈরি হওয়ায় এতে ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাকের জীবাণুও থাকে, যার ফলে বদহজম, ক্রিমি, বমবমি ভাব, ক্ষুদামন্দার মত অসুবিধার সৃষ্টি হয়। ভেজালযুক্ত মসলার হুমকি বড়দের থেকে শিশু ও নবজাতকদের জন্য আরো বেশি। এটি শিশুদের শারীরিক বর্ধনশীলতা ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্থ করছে, তাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দিচ্ছে যার ফলে সামান্য কারনেই অসুস্থ্যতার শিকার হচ্ছে বাচ্চারা বা অসুখ হলে দ্রুত সেরে উঠতে পারছে না। গর্ভবতীর খাবারে দূষিত মসলার প্রয়োগে তার গর্ভের সন্তান প্রতিবন্ধি ও অপুষ্ঠ হয়ে জন্ম নিতে পারে, এছাড়াও রয়েছে গর্ভপাত ও প্রসবকালীন জটিলতার সম্ভবনাও।
তাৎক্ষনিকভাবে ভেজাল খাবারের ক্ষতিকর দিকটা আমারা বুঝতে পারি না বলে অনেকেই এই বিষয়ে চিন্তিত নন। কিন্তু এইসব ভেজাল খাবার কাজ করে ঠিক আর্সেনিকের মতই, যার প্রভাব টের পাওয়া যার ধীরে ধীরে। নকল মসলায় নামীদামী ব্র্যান্ডের সিল খালি চোখে আসল ও নকলের বিভেদ তেমন বুঝতে না দিলেও মসলা কেনার সময় আমাদের থাকতে হবে সতর্ক। কিডনী ড্যামেজ, ডায়রিয়া, ক্যানসার, লিভারের ডায়োসিসের মত কঠিন সব রোগ থেকে বাঁচতে আমাদের ভেজালের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে হবে এবং তার সাথে খুঁজে নিতে হবে নিরাপদ সব খাদ্যের উৎস। অনেকে বাজারের দূষিত খাবার না কিনে অর্গানিক শাক-সবজি, মাছ-মাংস, মসলা ও অন্যান্য খাদ্যদ্রব্য কেনার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠছেন। তবে বাড়ির আঙ্গিনা বা বাসার ছাদে শাক-সবজি চাষের অভ্যাসও আপনাকে ভেজাল খাদ্য থেকে নিরাপদ রাখতে পারে অনেকটাই।
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ দৈনিক প্রথম আলো, মানবকন্ঠ, দৈনিক ইত্তেফাক, প্রিয়.কম, জাগো নিউজ২৪, কালের কন্ঠ, দৈনিক ইনকিলাব।

ভেজাল মসলা
Website | + posts
Cart
  • No products in the cart.