দেশের শতকরা ৭৫ থেকে ৮০ ভাগ জমিতেই চাষ হয় ধানের এবং মোট কৃষি জমির ৪ শতাংশ ও রবিশস্যের ১১ শতাংশ জমিতে চাষ হয় গম। এই ধান ও গম থেকে তৈরিকৃত খাদ্য উপাদান দ্বারাই মিটে চলেছে দেশের মানুষের ক্যালোরির চাহিদা। চালে রয়েছে এনার্জি, প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট, ফ্যাট, ভিটামিন-বি১, বি২, ফসফরাস, ক্যালসিয়াম, আয়রন ইত্যাদি, অন্যদিকে আটাতেও এই একই পুষ্টি উপাদানগুলো কিছু বেশি বা কম মাত্রায় উপস্থিত। কিন্তু বর্তমানে বাঙ্গালীর এই প্রধান দুটি খাদ্য উপাদানে দেদারছে মিশে চলেছে ক্ষতিকর কেমিক্যাল ও অখাদ্য সব জিনিসপত্র যা মানুষের স্বাস্থ্য নিয়ে দুশ্চিন্তাকে বাড়ীয়ে দিয়েছে ব্যাপক মাত্রায়।
ধান বা গমের ফলন বাড়াতে ব্যবহার করা হয় নানা জাতের সার, কীটপতঙ্গ যাতে ফসলের ক্ষতি না করতে পারে তাই একের পর এক চলে কীটনাশকের প্রয়োগও। আমেরিকান কেমিক্যাল সোসাইটির (এসিএস) এক গবেষণা থেকে জানা যায় আমাদের দেশের চালে ক্ষতিকর ধাতব পদার্থ ক্যাডমিয়ামের উপস্থিতির কথা। তাদের গবেষণায় যেখানে ০.০০৫৪ থেকে ০.০৫০৫ পিপিএম ক্যাডিয়ামকে নিরাপদ ধারা হচ্ছে সেখানে আমাদের দেশের চালে রয়েছে ০.০১ থেকে ০.৩ পিপিএম পরিমাণ ক্যাডিয়াম যা বিশ্বের দূষিত চালের প্রতিযোগিতায় আমাদের শীর্ষে তুলে দিয়েছে। নিম্ন মানের সার ও কীটনাশক ব্যবহারের ফলেই যে এই অর্জন তা ঐ গবেষণা থেকে স্পষ্টভাবে জানা যাচ্ছে, গম চাষের ক্ষেত্রেও চিত্রটা তেমন পরিবর্তন হয় না। বর্তমানে সরকারের স্বল্প পরিমানে চাল রপ্তানির পরিকল্পনা থকলেও বৈদেশিক বাজারের নির্ধারিত খাদ্যমান পূরনে ব্যর্থতা আমাদের সে পথও বন্ধ করে দিয়েছে। ধান থেকে চালে পরিনতের সময়ও চলে দুর্নীতি, ধান কয়েকবার সিদ্ধ করা, মোটা চাল কেটে চিকন চালে পরিণত করা, ওজন বাড়াতে কাঁকড়, ইটের গুড়া, পাথর, ভুসি ইত্যাদি মিশিয়ে দেওয়া অত্যন্ত নিয়মিত একটি ব্যপার। চাল যাতে চকচকে লাগে তাই এতে দেওয়া হয় মোমের প্রলেপ, নষ্ট চাল ঢাকতে পচা ময়দা ব্যবহারের সাথে সাথে সাদা ভাবের জন্য সোডিয়াম হাইড্রোক্সাইড নামক রাসায়নিক দ্রব্যও মেশানো হয়। এছাড়া বিভিন্ন রঙ, এরারুট, কৃত্রিম সুগন্ধ ও কেমিক্যাল দেওয়া হয় পুরনো, নষ্ট হয়ে যাওয়া চালকে বাজার উপযোগী করতে। এইসব জেনে ভাতের পরিবর্তে রুটি খেয়ে জীবন পার করবেন বলে ভাবছেন? তবে জেনে নিন আটার ভেজাল কাহিনীটাও। চাষের জমি থেক দূষণের পর্বটা শুরু হয় আটার আর চলতে থাকে আপনাকে গছিয়ে দেবার আগ পর্যন্ত। আটা ও ময়দার সাথে টিস্যু ও চকের গুড়ো মিশিয়ে দেবার মত তথ্যের প্রমাণ মিলেছে। খাদ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা নিশ্চিত করেছেন পচা ও ছত্রাকযুক্ত গম আমদানির ব্যাপারটা, আপনি যদি ভেবে থাকেন এইসব পচা গম ফেলে দিয়ে কোটি কোটি টাকার লোকসান ব্যবসায়ীরা গুনবে তবে আপনি বোকার স্বর্গে বাস করছেন !!! এই আমদানিকৃত পচা গমগুলোর আটা যাবে আপনার আমার পেটেই। সম্প্রতি ইন্ডিয়ায় দেখা গিয়েছে আটাতে পানি দিলে তা রবারের মত আকার ধারন করছে, কোন কেমিক্যালের প্রয়োগে আটার এই বেহাল অবস্থা তা জানা না গেলেও এই আটার রুটি খেয়ে অনেক মানুষের অসুস্থতার ব্যাপারটা নিশ্চিত হওয়া গেছে। ভারতের সীমানা পেরিয়ে আমাদের দেশে সেই একই মানের আটা যে প্রবেশ করেনি তার গ্যারান্টি কোথাও নেই। আমাদের দেশের আটায় মেয়াদ উত্তীর্ণের বালাই নেই তাই এতে ক্ষতিকর ছত্রাক ও ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি একটি পরিচিত ব্যপার। জানা যায় আটা ময়দা ও এর থেকে তৈরি খাদ্যের শতকরা ৯০ ভাগই নাকি খাবার অযোগ্য।
দূষিত এইসব খাবারের প্রভাবে পেটের সমস্যা এখন খুব স্বাভাবিক একটি ব্যাপার, বদহজম, গ্যাস্ট্রিক, আলসার থেকে শুরু করে তা একসময় পাকস্থলীর ক্যান্সারে পরিণত হয়। কিডনী, লিভার মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে এইসব খাবার খেলে, আবার স্নায়ু রোগের আশঙ্কাও রয়েছে যা আপনাকে পঙ্গু পর্যন্ত করে দিতে পারে। দূষিত খাবারের প্রভাবে আপনার রক্ত চলাচল বাধাগ্রস্থ হতে পারে যা হার্টের আসুখের প্রধান কারণ, এছাড়া ডায়াবেটিকস, ফুসফুসের অসুখ, হাঁপানি, এ্যালার্জি জন্যও দায়ী এইসব খাবার। শিশুদের সুস্থ্য ভাবে বেড়ে ওঠায় বাধা সৃষ্টি করছে ভেজাল খাবারগুলো, বুদ্ধি প্রতিবন্ধি ও বিকলঙ্গ সন্তান জন্মের হারও বেড়ে গেছে আগের তুলনায়, নিত্য অসুখ-বিসুখ লেগেই থাকছে তার সাথে দেখা দিচ্ছে বুদ্ধি স্বল্পতার সমস্যাও। গর্ভপাত, সন্তান ধারণে অক্ষমতা, অপুষ্ট শিশুর জন্মসহ নানা রকম অসুবিধায় ভুগছে মানুষ।
আতঙ্কিত এই পরিস্থিতি থেকে বাঁচতে সচেতনতা আবশ্যক, চাষ পদ্ধতিতে পরিবর্তনটাও জরুরি। সবার আগে শিশু ও গর্ভবতী নারীদের এইসব খাবার গ্রহন থেকে বিরত রাখতে হবে, চাল ও আটা কেনার সময় পরীক্ষা করে কিনতে হবে, দামে একটু বেশি হলেও যদি সম্ভব হয় অর্গানিক ভাবে তৈরি খাবারও কেনা যেতে পারে, তবে অন্তত নিরাপদ খাদ্য যাতে নিশ্চিত হয় সে ব্যপারে সচেতন থাকতে হবে। এছাড়া আমাদের কৃষকদের পণ্যের ন্যায্য দাম নিশ্চিত করার সাথে সাথে তাদের নৈতিক ও কারিগরি শিক্ষা দিতে হবে এবং তারা যাতে নিষিদ্ধ সার বা কীটনাশক ব্যবহার থেকে দূরে থাকে সে বিষয়ে খেয়ালও রাখতে হবে। এতে করে উৎপাদন পর্যায়ের দূষণের মাত্রা কিছুটা হলেও কমানো সম্ভব হবে বলে আশা রাখা যায়।
কৃতজ্ঞতাঃ কালের কণ্ঠ, দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক প্রথম আলো, প্রিয়.কম, ডেইলি সংগ্রাম, প্রজন্ম.কম, মানবকন্ঠ।