বিশ্বে ৩৭৫ মিলিয়ন ভেজিটেরিয়ানকে বাদ দিলে প্রায় সবার খাদ্য তালিকায় যে পরিচিত খাবারটির দেখা মিলবে তা হল ডিম। এটি শুধুমাত্র প্রাণীজ প্রোটিনের একটি সহজলভ্য ও সস্তা উৎসই নয় সাথে আমিষ, স্নেহ, খনিজ, ক্যালসিয়াম, ফ্যাট, মিনারেল, ক্যারোটিন ও ভিটামিনেরও সরবরাহকারি। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্য মতে সুস্থতার জন্য একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের বছরে কম করেও ১০৪টি ডিম খাওয়া উচিৎ। আমরা যারা বাংলাদেশী তাদের মধ্যে যেহেতু নিরামিষভোজীদের সংখ্যা নেই বললেই চলে তাই এদেশে ডিমের চাহিদা সব সময়ই বেশি, গ্রাম ও শহর মিলে প্রতিদিন ১২ মিলিয়ন ডিমের চাহিদা রয়েছে বলে জানা যায়, যার মোট সংখ্যা বছরে প্রায় ৪৩,৮০,০০,০০০ টি।
প্রতিদিনের এই বিপুল পরিমাণ মাংস এবং ডিমের চাহিদা মেটাতে দেশে গড়ে উঠেছে ছোট ও বড় মিলিয়ে প্রায় এক লক্ষ পোল্ট্রি ফার্ম। এদের দৈনিক ডিম উৎপাদনের সংখ্যা ১২.৫ মিলিয়ন যা ব্যবহৃত হয় বাসা বাড়িসহ বেকারি, রেস্টুরেন্ট, হোটেল, ফাস্টফুডের দোকানগুলোতে। দেশের ৯৫ শতাংশ ডিমের সরবরাহ হয়ে থাকে এমন ফার্ম থেকে বাকি ৫ শতাংশ আসে আমদানির মাধ্যমে। পুষ্টিগুণ, সস্তা আর মুখরোচক হবার দরুন ডিম আমাদের সবার প্রিয় তবে সর্বসাধারণের পছন্দের এই ডিমই যদি হয়ে যায় বিভিন্ন রোগ এবং অসুস্থতার জন্য দায়ী তবে তা আতঙ্কের কারণ বৈকি। মুরগীর সুস্থতা, ওজন বৃদ্ধি, ডিমের উৎপাদন বৃদ্ধি ও ডিম সাইজে বড় দেখাবার জন্য আজকাল খামারিরা আশ্রয় নিচ্ছে বিভিন্ন ঔষুধ, ভিটামিন আর কেমিক্যালযুক্ত খাবারের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় উঠে এসেছে মুরগীর খাবার হিসেবে টেনারি বর্জ্য ব্যবহারের কথা। চামড়া প্রক্রিয়া করার পর যে অবশিষ্টাংশ থাকে তাই সিদ্ধ করে, শুকিয়ে ও গুঁড়া করে চালান করা হয় খামারগুলোতে। আর মুরগীর ওজন বাড়ানোর খাতিরে খামারিরাও এই খাবার মুরগীকে দিতে আপত্তি করে না মোটেও।
চামড়ার মাননিয়ন্ত্রন, প্রক্রিয়াকরণ ও সংরক্ষণে ব্যবহৃত ১০০ এর বেশি কেমিক্যাল যার মধ্যে ক্রোমিয়াম ও ক্যাডমিয়াম অন্যতম কিন্তু ঠিকই রয়ে যাচ্ছে এইসব উচ্ছিষ্টে। নিয়মিত এইসব খাবার খাওয়ার ফলে মুরগীগুলো পুরো শরীরই ক্রোমিয়ামের ঘাটি হয়ে যাচ্ছে আর তা মুরগীর শরীর থেকে আসছে ডিমে। যেখানে দেহে ক্রোমিয়ামের সহনীয় মাত্রা ধরা হয় ৩৫ মাইক্রোগ্রাম সেখানে বাজারে প্রতি কেজি মুরগীতে পাওয়া যাচ্ছে ৩৫০ মাইক্রোগ্রাম ক্রোমিয়াম, এখান থেকেই ডিমে ক্রোমিয়ামের মাত্রা সম্পর্কে আপনি ধারণা করতে পারেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন যেহেতু ক্রোমিয়াম ২৯০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেট তাপমাত্রায়তেই শুধু নষ্ট হয় তাই রান্না দ্বারা এর বিষক্রিয়া দূর করা সম্ভব হবে না। সাধারণ মাত্রায় যেখানে মুরগীর খাদ্যে ৩০ পিপিএম রাসায়নিককে বিপদমুক্ত ধরা হয় সেখানে টেনারি বর্জ্য দ্বারা তৈরি এইসব খাদ্যে ৫০০০ পিপিএম রাসায়নিকের উপস্থিতি প্রমাণ হয়েছে। মূলত খামারিদের অজ্ঞতা ও অধিক লাভের আশা তাদের এইসব কেমিক্যালযুক্ত খাবার মুরগীকে দিতে উৎসাহিত করছে যা প্রকৃতপক্ষে পোল্ট্রি শিল্পকে দিনে দিনে হুমকির মুখে ফেলে দিচ্ছে।
এটি বিখ্যাত টিভির প্রতিবেদনে জৈনিক খামারি জানান মুরগী জন্মের ৪ দিন পর থেকেই দেওয়া হয় ভ্যাকসিন ও ভিটামিন, মুরগীর ওজন বাড়ানো ও ডিম বড় করার জন্যও আছে স্টেরয়েড ও মিথলিন নামক ঔষুধ। এইসব কেমিক্যাল মানবদেহে প্রবেশ করে বডিসেলকে ধ্বংস করতে শুরু করে এবং সৃষ্টি করে মরনব্যাধি ক্যান্সার। এরা হজমশক্তিকে দুর্বল করে দেয়, পাকস্থলি, কিডনি এবং লিভারকে আক্রমণ করে তাদের ধীরে ধীরে নিষ্ক্রিয় করে ফেলে, এছাড়াও নাম না জানা নানান রোগের বীজ বহন করে কেমিক্যালগুলো। বিভিন্ন অনুসন্ধান ও পরীক্ষা-নিরিক্ষার মাধ্যমে মুরগীর ডিমে এন্টিবায়োটিকের উপস্থিতির খবর নিশ্চিত হয়েছে যা এখন আমাদের সকলেরই জানা। মুরগীর শরীরে দেওয়া এইসব এন্টিবায়োটিক আমাদের শরীরে প্রবেশ করে দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে কমিয়ে দিচ্ছে আশঙ্কাজনক ভাবে। এমন ভাবে চলতে থাকলে একসময় হয়ত দেখা যাবে কোন এন্টিবায়োটিকই আর কাজ করছে না আমাদের শরীরে। বাজারের সব ডিমেই এখন পাওয়া যাচ্ছে সিপ্রোফ্লক্সাসিন নামের একজাতীয় এন্টিবায়োটিক আর অন্যান্য এন্টিবায়োটিকও শতকরা ৮০ ভাগ ডিমেই উপস্থিত রয়েছে, যা সহনশীল মাত্রা থেকে ৩ থেকে ৫ গুণ বেশি বলে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল থেকে জানানো হয়েছে। গর্ভাবস্থায় এই দূষিত ডিম খেলে গর্ভপাত, প্রসবকালীন জটিলতা ও বিকলাঙ্গ শিশু জন্মের সম্ভবনা থাকে বলে চিকিৎসকরা জানান। শিশুদের লিভার ডিজিস, গ্লডার ক্যান্সার, লিভার সিরোসিস, লাঞ্চ ক্যন্সার, হার্ট ব্লকসহ তাদের শরীরের ইমিউনিটি সিস্টেমকে পুরোপুরি ধ্বংস করে দিতে পারে এই কেমিক্যালগুলো।
তবে আশার কথা হচ্ছে দেশের সচেতন নাগরিকগণ এখন এই বিষয়ে অনেক সোচ্চার, ২০১১ সালে চামড়ার বর্জ্য দিয়ে মাছ মুরগীর খাবার উৎপাদন বন্ধের নির্দেশনা দিয়েছে হাই কোর্ট। আর অনেক শিক্ষিত খামারি অর্গানিক উপায়ে শুরু করেছে হাঁস-মুরগীর চাষ । এমন ছোট ছোট সচেতন পদক্ষেপেই একদিন আমরা ভেজালমুক্ত দেশ গড়তে সক্ষম হব, প্রয়োজন শুধু সঠিক মূল্য, নৈতিক শিক্ষা আর মূল্যবোধের।
কৃতজ্ঞতাঃ
ইন্ডিপেনডেন্ট টিভি, আরটিভি, এনটিভি, এটিএন বাংলা, যমুনা টিভি, সময় নিউজ, একুশে টিভি।

Website | + posts
Cart
  • No products in the cart.