ভেজাল শব্দের সাথে আমাদের পরিচয়টা নতুন নয়। বাজারের প্রায় সব পণ্যের মধ্যেই মেলে এই ভেজালের উপস্থিতি। চাল, ডাল, তেল, নুন, মসলা, মাংস, সবজি, ভেজালের লিস্টটা যেন শুধু বড়ই হচ্ছে দিন দিন। চাল আর ডালের ক্ষেত্রে ভেজালের মাত্রা অন্যদের তুলনায় আগে কিছু কম ছিল, কিন্তু নৈতিক জ্ঞানহীন ব্যবসায়ীদের দৌলুতে এখন এগুলোও আর ভেজাল ছাড়া পাওয়া উপায় নেই। ডাল আমাদের সবার প্রিয়, এমনো বাঙ্গালী আছেন যাদের শত রকমের খাবারের ভিড়েও ডাল ছাড়া খাওয়ায় তৃপ্তি আসে না। আবার যারা প্রণীজ আমিষ এড়িয়ে চলতে চান তাদের জন্য ডাল একটি উৎকৃষ্ট আমিষের উৎস। খনিজ পদার্থ, ক্যালসিয়াম, ক্যরোটিন, শর্করা, ভিটামিন বি ১২, প্রোটিন, আয়রন, ফাইবার, পটাশিয়াম, সোডিয়ামসহ প্রায় সব ধরনের পুষ্টিগুণই রয়েছে ডালে। প্রতিদিনের প্রোটিনের চাহিদার অনেকটায় পূরণ করতে পারে ডাল।
স্বাদে অসাধারন ও দামে কিছুটা সস্তা হওয়ায় ডাল নিত্যদিনের প্রোটিনের চাহিদা মেটাতে বহুল হারে ব্যবহৃত হয়। প্রতিদেনের আমিষের প্রায় ২০ থেকে ২৫ ভাগ চাহিদা পূরণে সক্ষম এই ডাল এদেশের মাত্র ৫-৭ শতাংশ কৃষিজমিতেই চাষ হয়ে থাকে, যার ফলে চাহিদা মেটাতে নিতে হয় আমদানির সাহায্য। প্রতি বছর ২ হাজার কোটি টাকার ডাল আমদানি হয় ভারত, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, তুরস্ক ও নেপাল থেকে। ডালের এমন ক্রমবর্ধমান চাহিদার সুযোগ নিয়ে একজাতীয় অসাধু ব্যবসায়ী ডালে মেশাচ্ছে রাসায়নিক দ্রব্য ও রঙ, ওজন বৃদ্ধির জন্য পানি মিশিয়ে বিক্রি করছে ভেজা ডাল। কাপড়ের ক্ষতিকর রঙ মিশিয়ে কলাইয়ের ডালকে বানানো হচ্ছে মুগ ডাল আর কেজিতে ৪৫ থেকে ৫০ টাকা বাড়তি বিক্রির আশায় কলাইয়ের ডালকে মেশিনের সাহায্যে ছোট করে তাতে রাসায়নিক পদার্থ, ক্ষতিকর রঙ, হদুল ও তেল মিশিয়ে তাকে মুগ ডালে পরিণত করা হচ্ছে। অনুসন্ধানে উঠে এসেছে যে প্রতিদিন প্রায় ২০ থেকে ২৫ টন ভেজাল ডাল বিক্রি হয় বাজারে, যা মোট চাহিদার প্রায় চার ভাগের এক ভাগ। এছাড়াও গরুর খাবার হিসেবে ব্যবহৃত এ্যাঙ্কার ডাল নির্বিচারে মেশানো হচ্ছে ডালের সাথে যা মানবদেহের জন্য মোটেও স্বাস্থ্যসম্মত নয়। মসুর ডালের সাথে এ ডালের কিছু সাদৃশ্য থাকায় ব্যাপারীরা তার সুযোগ নিয়ে মিশিয়ে দিচ্ছে এই গরুর খাবারটি মানুষের খাবারের সাথে। ওজনে বেশি দেখানোর জন্য ভেজা ডালই নিয়ে আসছে বাজারে, ভেজা অবস্থার ডাল খুব সহজেই ফাঙ্গাস দ্বারা আক্রান্ত হয়ে পড়ে যার ফলে এটি পেটে যাবার সাথে সাথেই দেখা দেয় পেটের গণ্ডগোল, হয়ে যায় ফুড পয়জনিং এর মত রোগ। অনেক দিনের নষ্ট ডাল বা পোকায় কাটা ডাল মেশিন দিয়ে ছোট এবং পরিষ্কার করে তাতে রঙ মিশিয়ে চকচকে বানিয়ে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে বাজারে আর ভোক্তারা চকচকে ডালকে নতুন ভেবে কিনে নিচ্ছে নিশ্চিত মনে। কিন্তু নষ্ট বা ছত্রাক আক্রান্ত ডালগুলোতে ঠিকই থেকে যাচ্ছে ক্ষতিকর জীবাণু, অন্যদিকে কেমিক্যাল ও রঙের প্রভাবে তা আরো বেশি মাত্রায় দূষিত হয়ে পড়ছে।
রাসায়নিক মিশ্রিত ডাল স্বাভাবিক ভাবেই সহজে সিদ্ধ হতে চাই না, রান্নার পর এতে না থাকে তেমন স্বাদ না পাওয়া যায় সুবাস। চায়নিজ ডাল হিসেবে পরিচিত এই ডাল খেলে হতে পারে পেটের সমস্যা, দীর্ঘদিন খেলে নষ্ট হয়ে যেতে পারে কিডনি। গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা, আলসার, যকৃতের ক্যান্সার, পাকস্থলীর ক্যান্সার, গল ব্লাডারের ক্যান্সার সহ আপনি আক্রান্ত হতে পারেন হার্টের সমস্যা, ব্লাড প্রেসার, ডায়াবেটিকেসের মত অসংখ জটিল রোগে। কেমিক্যালের প্রভাবে আপনার স্নায়ু দুর্বল হয়ে যেতে পারে এবং দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকেও কমতে পারে আশঙ্কাজনক ভাবে। মানুষের খাবার অনুপযোগী এইসব খাদ্য খেলে দেখা দেয় স্কিনের সমস্যা, চর্মরোগ, এমনকি হতে পারে স্কিন ক্যান্সারও। চুল পড়া, ত্বকের সজীবতাহীনতা, অসময়ে চুলে পাক ধরা বা বুড়িয়ে যাবার মত ঘটনা এত বেড়ে যাবার পেছনে ভেজাল খাবারের অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই। এগুলো ভেতর থেকে মানুষের শরীরে ক্ষয় ধরিয়ে দিচ্ছে যার ফলে দেখা দিচ্ছে দুর্বলতা, মানসিক অবসাদ, দুশ্চিন্তা, ঘুম না হওয়ার মত অসুখ। ডালে মিশ্রিত কেমিক্যালের জন্য আপনার শিশুর স্বাভাবিক বিকাশ বাধাগ্রস্থ হতে পারে, তাদের ব্রেন ডেভেলপমেন্ট থেমে যেতে পারে, হতে পারে এস্থিমা, মানসিক ভারসম্যহীনতা, দৃষ্টিহীনতার মত জটিল রোগ। শুধু তাই নয়, গর্ভাবস্থায় গর্ভের শিশুকে বিকলঙ্গতা থেকে বাঁচাতে এমন ভেজাল খাওয়া থেকে আপনার বিরত থাকা উচিৎ।
বিভিন্ন প্রকার ডালের মধ্যে মসুর, মুগ ও ছোলা ডালের কদর এদেশে একটু বেশি হওয়ায় এদের দূষণটাও তুলনায় বেশি হয়ে থাকে। ভারত থেকে আমদানিকৃত ডালের মধ্যেও দেখা মেলে এইসব ক্ষতিকর পদার্থসমূহের। মূলত মান নিয়ন্ত্রণ ও যাচাইয়ের কোন উপযুক্ত ব্যবস্থা না থাকায় এমন দূষনের পরিমাণ দিন দিন বেড়েই চলেছে। শস্য সঠিক উপারে সংরক্ষণের জন্য চাই সংরক্ষণাগার, ট্রেনিং প্রদানের মাধ্যমে কৃষকদের জানাতে হবে শস্য নিরাপদ রাখার সঠিক উপায় আর তাদের ভেজাল পণ্যের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কেও জানানোটা জরুরি, কেবল মাত্র তাহলেই আমরা থাকতে পারব নিরাপদ ও দূষণমুক্ত।
সূত্রঃ কালের কন্ঠ, প্রথম আলো, মানবজমিন, ইত্তেফাক, পিএনএস নিউজ২৪, কারেন্ট নিউজ, জাগো নিউজ, উকিপিডিয়া।