ঘৃতকুমারী ঔষধি উদ্ভিদ :
প্রাচীন যুগ থেকে ঘৃতকুমারী বা অ্যালোভেরা ব্যবহার উপযোগী বহুজীবি ভেষজ ঔষধি উদ্ভিদ প্র-জাতির গাছ এবংএটি রসযুক্ত লালার মত পিচ্ছিল শাসঁ এবং গাছটির রসযুক্ত শাসঁ রুপচর্চার জন্য ব্যবহার উপযোগী। ।গাছটি দেখতে কিছুটা আনারসের গাছের মত এবং পাতা গাঢ় সবুজ বর্ন ও চওড়া, পুরু । পাতার দু’ধার কাঁটা যুক্ত এবং করাতের মত ধারঁ রয়েছে।পাতায় ২০ ধরনের খনিজ পদার্থ রয়েছে ।এগুলো হল – সোডিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, ম্যাংগানিজ, ক্রোমিয়াম, আয়রন ,সেলেনিয়াম,পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম ,কপার ও জিংক এবংমানব দেহের প্রয়োজনীয় এ-মিনো এসিডের ৮টি এতে পাওয়া য়ায়।এ উদ্ভিদটি আফ্রিকার মরুভূমি ও মাদাগাস্কার এলাকায় পাওয়া য়ায় । বৈজ্ঞানিক নাম ঘৃতকুমার (Aloe Vera) এবং ইংরেজিতে (Medicinal aloe, Burn plant) বলা হয়ে থাকে।
ঘৃতকুমারী–তে ভিটামিন বি-১ , বি-২,বি-৩,বি-৬, এ ,সি এবং ই রয়েছে। ভিটামিন বি-১২ আছে এমন অল্পসংখ্যক উদ্ভিদের মধ্যে একটি।
প্রাচীন কাল থেকেই ঘৃতকুমারীর বিভিন্ন উপায় ব্যবহার হয়ে আসছে। রানি ক্লিওপেট্রার সৌন্দর্যের রহস্য ছিল এই উদ্ভিদটি । এছাড়াও ইতিহাসবিদদের অনেকেই ছিলেন যে ধৃতকুমারী রস সেবন করতেন তার মধ্যে ছিলেন– নেপোলিয়ন ,সম্রাট আলেকজান্ডার, মহাত্মা গান্ধী, বাদশাহ্ সোলায়মান, ক্রিস্টোফার কলম্বাস । সারা পৃথিবীতে প্রায় ২৫০ ধরনের প্র-জাতির ঘৃতকুমারীর গাছ পাওয়া যায়। এর মধ্যে মাএ দু’ধরনের প্রজাতির গাছ বানিজ্যিক ভাবে চাষ হয়ে থাকে।
ঘৃতকুমারী বা অ্যালোভেরার ব্যবহার্য অংশ :
মূলত এটির পাতা বা শাঁসের রস/ জেল ব্যবহার হয় থাকে। এর পাতার রস/ জেল যকৃতের জন্য বেশ উপকারী। ঘৃতকুমারীর রস নিয়মিত দিনে দুইবার পান করা উচিত এবং প্রতিবারে প্রায় ১০ মিলিলিটার পরিমান রস পান করা উচিত। এটি যেমন ত্বক লাবন্যেময় করার জন্য বিশেষ কাজ করে আবার শরীরের ভীতরে এবং শরীরের উপরে ও জাদুকরী কাজ করে থাকে।
ঘৃতকুমারী বা অ্যালোভেরার রস/জেলের জাদুকরী ঔষধি গুণসমূহ:
- নিয়মিত এ উদ্ভিদের রস/ জেল সেবনে দেহের পরিপাক-তন্ত্র সুস্থ ও সতেজ থাকে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য ও দূর করে দেয়। ঘৃতকুমারীর রস ডায়রিয়া সাড়াতেও দারুণ কাজ করে।
- এ উদ্ভিদের পাতার রস/ জেল ত্বকের উপর লাগালে ত্বকের উজ্জলতা বৃদ্ধি পায় এবং ত্বকের রোদে পোড়া দাগের ক্ষেত্রেও উপকারী।
- শরীরের শক্তি এবং ওজন ঠিক রাখতে নিয়মিত ঘৃতকুমারীর রস / জেল সেবন অত্যন্ত উপকারী কারণ এ পাতায় চর্বি কমানোর উপাদান রয়েছে।
- এ পাতার রস/ জেল হাড়ের সন্ধিকে সহজ করে এবং দেহে নতুন কোষ তৈরি করতে সাহায্য করে এবং হাড় সহ মাংশপেশীর জোড়া গুলোকে শক্তিশালী করে তুলে এবং শরীরের বিভিন্ন প্রদাহ প্রশমনেও কাজ করে।
- মুখের মেছতা দূর করতে ঘৃতকুমারীর রস/ জেল জাদুর মত কাজ করে।
- এ পাতার রস/ জেল মানুষের শরীরের ভেতরের যাবতীয় আবর্জনা পরিষ্কার করে প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে পরিশোধিত করে।
- চুলে ঘৃতকুমারী রস/ জেল নিয়মিত ব্যবহারে চুলের হারানো উজ্জ্বলতা ফিরে আসে এবং খুসকির সমস্যা ও দূর করে। সপ্তাহে দুদিন চুলের গোড়ায় পাতার রস ব্যবহারে, মাত্র এক মাসের মধ্যে ফলাফল মোলায়েম ও ঝরঝরে চুল।
- পাতার রস/ জেল সাদা রক্তকণিকা গঠনে সহায়তা করে ও বিভিন্ন ভাইরাসের সাথে লড়াই করে।
- অধিক পরিশ্রমের ফলে এন-জাইম নামক ভাইরাস শরীরের ভীতরে কাজ করে শরীরকে করে তোলে ক্লান্ত ও শ্রান্ত , ঘৃতকুমারীর রস/ জেল নিয়মিত সেবনে শরীরের ভারসাম্য রক্ষা করে শরীরের ক্লান্তি ও শ্রান্তি দূর করে এবং সুস্থ ও সবল রাখে।
- ঘৃতকুমারী পাতার শরবত শরীরের মিনারেলস এবং ভিটামিন এর ব্যালেন্স করতে সাহায্য করে।
- অত্যাধিক গরমের সময় “হিট স্ট্রোক” হওয়া থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করে।
- অনিয়মিত এবং অস্বাভাবিক ঋতু কে নিয়মিত করতে এটি বেশ উপকারী।
- হঠাৎ উছু-নিচুতে পা পড়ে গেলে বা কোন ভারি কিছু জিনিস তুলতে গেলে বা হঠাৎ কোমরে ফিক ব্যথা হলে ঘৃতকুমারীর শাঁস বা জেল মালিশ করলে খুব সহজেই উপকার পাওয়া যায়।
- ঘৃতকুমারী পাতার রস/ জেল ক্ষত স্থান খুব দ্রুত সারাতে সাহায্য করে।
- ঘৃতকুমারীতে রসে রয়েছে আশ্চর্য ঔষধি গুন যা রক্তে কোলেস্টেরল এবং চিনির মাত্রা স্বাভাবিক অবস্থায় নিতে সাহায্য করে এবং রক্তচাপও স্বাভাবিক মাএায় আনতে সাহায্য করে।
- পাতার রস হাত-পায়ের জোড়ার জড়তা দূর করে এবং হাড়ের গিঁটের ব্যথা কমাতেও সহায়তা করে।
- শাঁস/জেলে ই-মিউন সিস্টেম কে প্রভাবিত করে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
- ঘৃতকুমারীর জেলী নিয়মিত ব্যবহারে চর্মরোগ, এবং মুখের ব্রন দূর করতে সাহায্য করে।
- শীতকালীন সাধারণ সমস্যার একটি পায়ের গোঁড়ালি ফাঁটা। পায়ের গোঁড়ালি ফাঁটা বা ফাঁটা দাগ দূর করতে কয়েক ফোটা ঘৃতকুমারীর রস/ জেলই যথেষ্ট কার্যকারী। ফাঁটা জায়গায় ঘৃতকুমারীর রস/ জেল কয়েক ফোঁটা নিয়ে ম্যাসাজ করলে এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। তবে সাবধান ফাটাঁ জায়গায় খুব জোড়ে ঘষা যাবে না।
- বয়সের সাথে সাথে ত্বকে বলিরেখা পড়া স্বাভাবিক সমস্যা। আর এসব সমস্যা দূর করতে ঘৃতকুমারী রস / জেল বেশ কার্যকরী।ধৃতকুমারী রস বলিরেখা দূর করে ত্বকে ফিরিয়ে আনে তারুণ্যের দীপ্তি। তাই নিয়মিত ঘৃতকুমারী রস ব্যবহার করতে পারেন।
- নিয়মিত ধৃতকুমারীর রস/জেল ক্লিনজার হিসাবে ব্যবহারে মুখের হোয়াইট টোন দিনে দিনে বৃদ্ধি পায় এবং নিয়মিত ব্যকহারে ত্বককে নরম, কোমল ও উজ্জ্বল করে তুলে।
- ঘৃতকুমারীর পাতার রস/ জেল মুখের আদ্রতা ধরে রাখতে এর কোন জুড়ি নেই। এর নিয়মিত ব্যবহারের ফলে পর্যাপ্ত পরিমান আদ্রতা স্বাস্থ্যকর ত্বকের নিশ্চয়তা দেয়।
- ঘুমানোর আগে প্রতিদিন রাতে ঠোঁটে কয়েক ফোঁটা ঘৃতকুমারীর রস/জেল লাগালে ঠোঁট নরম ও উজ্জ্বল হবে। কারন ঠোঁটের ত্বক, মুখের ত্বকের তুলনায় অনেক কোমল হয় এবং দূষণের কারণে ঠোঁট চুপসে যায় তাই এর ব্যবহারে কোন বিকল্প নাই।
- দাঁতের মাড়ির স্বাস্থ্য সবল রাখার জন্য কয়েক ফোটাঁ পাতার রস বেশ কার্যকর।
- কয়েক ফোঁটা পাতার রস/ জেল দিয়ে ক্ষতস্থানে নিয়মিত মৃদৃভাবে ম্যাসাজ করলে ক্ষতস্থানে সেরে যায়।
- এ পাতার রস নিয়মিত সেবনে পরিপাক ও রেচন যন্ত্রকে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া মুক্ত রাখে।ফলে পেটে ক্রিমি হওয়ার কোনো আশঙ্কাই থাকেই না, কিংবা ক্রিমি থাকলেও সেটা দূর করে।এছাড়া ঘৃতকুমারীর রস বা জেল আঠালো প্রকৃতির হওয়ায় খাদ্যনালীর ভেতর দিয়ে যখন দেহের ভেতরে প্রবেশের করে তখন পরিপাকতন্ত্রকে পরিষ্কার করতে করতে যায় এবং দেহকে দেহের ভেতর থেকেই দূষণ মুক্ত করে।
- আজকাল মানুষের খাদ্যাভ্যাস এমন পর্যায়ে চলে গেছে যে খুব কম লোকই আছেন যে অ্যাসিডের সমস্যায় ভুগতেছে না।আর মাঝে মধ্যে ধৃতকুমারীর রস বা জেল পান করলে এ সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
- অনেক আছেন ওজন জনিত সমস্যায় ভুগছেন আর তাই নিয়মিত ঘৃতকুমারীর রস বা জেল পান করলে শারীরিক কর্মশক্তি বাড়ে ফলে ওজন জনিত সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
- এমন অনেকই আছেন যারা খাদ্য হজম জনিত সমস্যায় ভূগছেন । খাদ্য হজম জন্য নিয়মিত এ পাতার রস পান করলে এ সমস্যা হতে মুক্তি পাওয়া যায় আবার হজম শক্তিও বৃদ্ধি করে থাকে।
- বাহ্যিক সমস্যা গুলো মধ্যে ফুসকুড়ি পড়া ও পোকার কামড়ের ক্ষত স্থান সারিয়ে তুলতে সহায়ক এ পাতার রস।
- নিয়মিত ধৃতকুমারী পাতার রস পান করলে দেহের ভীতরের ভাইরাসের সঙ্গে লড়াই করার জন্য দেহে মধ্যে সাদা ব্লাড সেল গঠন করে ।
- ধৃতকুমারীর রস পুরো মাথার ত্বকে ম্যাসাজ করে এক ঘণ্টা যাবৎ রেখে ধুয়ে ফেলুন এতে চুল পড়া বন্ধ হবে এবং মাথায় নতুন চুল গজাবে।
- চুলকে ঝলমলে ও উজ্জল করার জন্য শ্যাম্পু করার ঠিক আধা ঘণ্টা আগে ধৃতকুমারীর রস বা জেল ব্যবহার করতে হয়।
ধৃতকুমারী বা অ্যালোভেরা চাষের পদ্ধতি:
মোটামুটি সব জমিতেই ধৃতকুমারী বা অ্যালোভেরা চাষ হয়ে থাকে। তবে দোঁ-আশ মাটি ও বালু মিশ্রিত মাটিতে গাছের বৃদ্ধি খুব ভালো হয়। যেসব জমিতে পানি জমে না আথাৎ উঁচু জমিতে এর চাষ করা হয় ।কারন নিচু ও পানি জমে এমন জমিতে গাছ পচে যায়।দো-আঁশ মাটিতে ধৃতকুমারী বা অ্যালোভেরা গাছের চাষ ভাল হলেও বেলে দো-আঁশ মাটিতে চাষ সবচেয়ে উত্তম।খুব ভাল ফলন পাওয়ার জন্য রোদ্র উজ্জল জমিতে চাষ করতে হয়।
আমাদের এ লেখাটি ভালো লাগলে আরো পড়তে পারেন :